Wednesday 16 September 2009

বিলাতের সাত সতেরো-১


সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেল, উঠতে ইচ্ছা করছিল না, ভারী কম্বল গায়ে অনেক ক্ষন শুয়েই রইলাম। গত কয়েক দিন থেকে তুষার পাত হচ্ছে। আমার আবার গাড়ি নেই। কঠিন ডায়াবেটিকের রুগী বলে নাকি আমি গাড়ি চালাতে পারবো না তাই আর লাইসেন্স রিনিউ করেনি, সঙ্গে কয়েক গাঠঠি উপদেশ দিয়ে ফেরত দিয়ে দিয়েছে। নিজেকে ভীষন অক্ষম মনে হয়েছিলো। মনটা ভাঙ্গি ভাঙ্গি ভাব ধরেছিলো। আচ্ছা বলুনতো বিলাতে কি গাড়ি ছাড়া চলে? ভাবলাম যাক গাড়ি না থাকার উছিলায় ডায়াবেটিকের রুগীর হাটা হাটি করা হবে এই মনে করে মনকে প্রবোধ দিলাম।

এক সময়তো উঠতেই হবে তাই লাফ দিয়ে উঠেই পরলাম। সকালের কাজ কর্ম সেরে কিচেনে গেলাম। কি খাই? ব্রেড? কর্ণ ফ্ল্যাকস? পরীজ? মৌজলি? নুডলস? কিছুই যে আর খেতে ভালো লাগে না। মনে হচ্ছিলো এই তুষার সকালে ভাজা ইলিশের সাথে গড়ম খিচুরী হলে, আপনারা কি বলেন? না ভাজ্ঞ্যে আছে টোস্টেড ব্রেড বাটার আর তার সাথে কিছু বেকড বিনস, তাই খেয়ে চায়ের কাপটা হাতে ঘরে এসে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি ঝুর ঝুর করে স্নো পরেই চলেছে রাস্তায় অন্তত ৬ ইঞ্চি বরফ জমেছে কোন গাড়ি দেখলাম না, এই বরফের মধ্যে গাড়ি চলেই বা কি করে। ঘড়ির সাথে লাগানো মিটারে দেখলাম ঘড়ের ভিতরে তাপ ১৪ ডীগ্রিতে নেমে এসেছে অথচ রাতে শোবার আগে ২৩ ডীগ্রি দেখেছিলাম, কি পরিমান ঠান্ডা! পর্দা সরিয়ে আলগা হিটারটা টেবিলের নিচে রেখে চেয়ারে বসলাম। গড়ম ধোয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি, দৃষ্টি চলে গেল সামনের রাস্তা পেড়িয়ে ওই দূরের জঙ্গলের দিকে। ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে বরফ জমে সব কিছু হালকা মরি মরি ভাবের নীলে মেশানো সাদায় ভরে আছে। কেমন একটা মায়া ভরা দৃশ্য। কাল রাতে ডিউটি শেষে ফেড়ার পথে নাক দিয়ে নিশ্বাসের সাথে পেটের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা গড়ম বাষ্প, চোখে স্নো ছিটে এসে জ্বালা ধরানো পানি বের হওয়া আর শীতের ভাব দেখেই বুঝেছিলাম এই স্নো আর কদিন থাকবে কে জানে। বাস থেকে নেমে সামনে যে পাবটা সেখানে ভীড় নেই, কে আসে এই বরফ বিছানো রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে? সবাই যার যার ঘরে হিটারের কাছে বসেই বিয়ারের গ্লাশ নিয়ে বসেছে।

হাতে চায়ের কাপ আর চোখে সামনের ঝুর ঝুর তুষার পরার দৃশ্য। মনটা উদাস হয়ে চলে গেল আষাঢ় মাসে। আষাঢ়ের সাথে এই তুষারের তুলনা চলে না তবুও মন যখন ভেবে নিয়েছে কি করি মনের সাথে আমিও চলে গেলাম। টিনের চালের বারান্দায় বসে চোখ চলে গেল বাড়ির সামনে বাগানে কামিনী গাছে ফোটা ফুল বৃষ্টির ভার সইতে না পেরে ঝড়ে পরেছে তা ছাড়িয়ে নদীর ওপাড়ে তাল গাছের মাথায়। চালের রিম ঝিম সুর আর নদি থেকে ভেষে আসা ভেজা বাতাসে সেদিনও এমনই ভাব হয়েছিল। কত বতসর হবে? হ্যা তা প্রায় আঠারো বতসরতো হবেই, খুকু যখন চার বছরের। ভেজা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাইরে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরে ধরে এনে আমাকে দিচ্ছিলো, বাবা দেখ বিত্তি এনেছি কি সুন্দর না বাবা?হ্যা মা সুন্দর, খুবই সুন্দর। দেখ মা ওইযে তাল গাছটা একা কেমন করে ভিজছে। ও ভিজছে কেন বাবা? ঘড়ে আসতে পারে না?সেদিন তাল গাছের ঘড়ে আসা না আসা নিয়ে খুকুকে কোন জবাব দিতে পারিনি। সেই খুকু কাল বিলাত আসছে। আমার প্রথম সন্তান। আমার খুকু, শারমিন আশরাফী। কাল আমাকে লন্ডনে হিথ্রো এয়ারপোর্টে যেতে হবে। তিন দিনের ছুটি নিয়েছি। এই বরফ বিছানো পথে কোচ কি চলবে? মনে একটা প্রশ্ন এলো। এখানকার রাস্তায়তো কোন গাড়ি চলছে না, কি জানি মটর ওয়েতে কি হয়ে রয়েছে কে জানে। যদি না চলে তাহলে খুকু কি করবে? হিথ্রো এয়ারপোর্টে নেমে ইমিগ্রেশন, লাগজ কালেকশন, কাস্টমের ঝামেলা ছাড়িয়ে যখন বাইরে এসে দেখবে বাবা নেই তখন কি করবে? নিজে যাচ্ছি বলে কাওকে বলাও হয়নি যে সে গিয়ে নিয়ে আসবে। আজ রাতের কোচে যবার কথা। কি হবে কে জানে। ওকে রিসিভ করে বাসায় কলেজে ভর্তি করে প্রয়োজনিয় সব কিছু দেখিয়ে চিনিয়ে দিয়ে আসবো।এই রকমই ভেবে রেখেছি। কত দিন পরে দেখবো খুকুকে, মনটা স্বাভাবিক ভাবে একটু চঞ্চল হয়েই ছিলো। এই এতো বছর পরে বাবাকে দেখে খুকু কি করবে, খুকুকে প্রথম দেখে কি ভাবে বুকে জড়িয়ে ধরে এতো দিনের জমা মরু তৃশার মত পিতৃ স্নেহ কি ভাবে নিবাড়িত হবে এই নিয়ে কত কি ভেবেছি। সেদিনের বিত্তি ধরে আনা খুকু আজ একা একাই বিলাত আসছে, পড়তে। লন্ডনে একাই থাকবে। ভাবতে ভাবতে কখন যে বাইরে্র স্নোর সাথে চোখে্র স্নো টপ টপ করে গলে গলে পরতে শুরু করেছে বুঝিনি।
আমি থাকি নিউ ক্যাসেলের পাশে ছোট্ট সাউথ শিল্ড শহরে। ও যা পড়তে আসছে নিউক্যাসেল বা তার আশে পাশে ডারহ্যাম, সান্ডারল্যান্ড ইউনিভার্সিটিতে তা অনেক বেশি খরচ। এতো খরচ যোগান দেবার সামর্থ্য কলিম আশরাফীর নেই, তাই বাবা আর মেয়ের একত্রে থাকার ব্যবস্থাও নেই। খুকু বলেছিল তাহলে আর আমি গিয়ে কি করবো? আমি বিলাতে থাকবো আর তোমাকে রান্না করে খেতে হবে তাই যদি হয় তাহলে এতো টাকা খরচ করে গিয়ে কাজ নেই। এ কথা শুনে গিন্নী মা মানে মেঝ মেয়ে শায়লা আশরফী বলেছে তাই কি, তুমি যাও। বাবা মাঝে মাঝে আসবে আর বাবা যা খেতে পছন্দ করে তুমি রান্না করে খাওয়াবে যাবার সময় সাথে কিছু দিয়ে দিবে যাতে কয়েক দিন খেতে পারে। মানুষে ভিসা পায় না বলে যেতে পারে না আর তুমি এতো সহজে ভিসা পেয়ে সে সুজোগ হাত ছাড়া করবে কেন?তবুওতো মাঝে মাঝে বাবাকে দেখতে পাবে, আমরা যে কবেই বাবাকে দেখবো, বাবার ছবি না থাকলে বাবার চেহাড়াটাই ভুলে যেতাম। তুমি যাও বড় আপু বাবাকে দেখে রেখো। ওদের মা যামিনী, সেও খরচের কথা ভেবে আসতে দিতে চাইছিলো না।

যামিনী যেদিন আমার জীবনে প্রথম এসেছিলো সেদিনের কথা এই পচিশ বছরেও ভুলি নি আজো পরিষ্কার মনে আছে। কেমন যেন একটা ঝড়ের মত ব্যপার হয়ে গেল। স্কুলের মাষ্টারি করে প্রাইভেট ছাত্রী পড়িয়ে বাড়ি ফিরছিলো। সেদিনো ছিল এমনি ঝড় জলে মাখানো এক মায়াবী রাত। আগে দেখেছি রাস্তা দিয়ে যেতে আসতে, কখনো কথা হয়নি তবে ওরা খ্রিষ্টান এটুকুই জানতাম। মনে কি কখনো কিছু উদয় হয়েছিলো কিনা তখনো বুঝিনি। তখন পড়াশুনার পাট শেষ করে মাত্র চাকরীতে ঢুকেছি, খুলনা শহরের এক পাশে ছোট একটা রুম ভাড়া নিয়ে থাকি। সাত কুলে কেও নেই কারো জন্য মায়া দয়া ভালোবাসা বা পিছুটান বলতে কিছুই নেই। মরিয়ম এসে রান্না করে রেখে যায় তাই খাই, যা দরকার একটা কাগজে কোন রকম আকার ইকার ছাড়া লিস্ট লিখে টেবিলের উপরে রেখে যায়, আমি আবার সেই লেখা দেখে যা উদ্ধার করতে পারি তা কিনে এনে রান্না ঘড়ে রেখে দিই, ওর সাথে আমার দেখা হয় না বললেই চলে। সেদিন অফিস থেকে ফিরে রাতে ঘরে চোকিতে শুয়ে দিনে না পড়া কাগজটা দেখছিলাম। হঠাত একটা নাড়ী কন্ঠের চিতকার শুনে চমকে এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝতে পারলাম রাস্তার দিক থেকেই এসেছে শব্দটা। গুরুত্ব দিলাম না, সঙ্গে সঙ্গে আবার একটু আস্তে সেই চিতকার বাচাও! কি ব্যপার, এরকমতো কখনো শুনিনি, এলাকাটা ভালো না জানি তবুও কখনো এরকম শুনিনি। কি করি ভাবছি, মনে হোল ভাবা ভাবির কি আছে দেখি না কি হচ্ছে। সঙ্গত কারনেই পুরুষ মানুষের সাহস নিয়ে দরজাটা খুলেই দেখি আমার ঘরের দিকে সেই মহিলা দৌড়ে আসছে চিনতে পারলাম, পায়ে স্যান্ডেল নেই, শারিটা ভিজে চুপচুপে কাদা জল ছিটিয়ে ঝড়ের মতই বারান্দায় এসে দাড়ালো, হাফাচ্ছে, আমাকে বাচান। পিছনে ওই রাস্তার দিক থেকে দেখলাম দুই জন ষন্ডা মার্কা লোক কি সব বলতে বলতে ফিরে যাচ্ছে। ঘটনা বুঝতে কিছু বাকী রইলোনা। পিছনে ঘুরে দেখি যামিনী ঘরের ভিতরে দাঁড়িয়ে থর থরিয়ে কাপছে। কি হয়েছে? কোন জবাব নেই। বুঝলাম একটু শান্ত না হলে কিছু বলতে পারবে না। দরজাটা বন্ধ করবো না কি করবো ঠিক করতে পারছিলাম না। ওই এগিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তোয়ালেটা হাতে ধরিয়ে চেয়ারটা দেখিয়ে দিলাম।  তোয়ালে হাতে অনেকক্ষন দাড়িয়েই রইলো। সেদিন যেন যামিনীকে ভিন্নভাবে আবিষ্কার করলাম। যাক, এই হোল সেই যামিনী যে যামিনী এখন আমার স্বপ্ন, সাধ, আহ্লাদ, শক্তি, জীবন, আমার সব। আমার জীবনে যা কোন দিন ছিলো না তা সব দিয়েছে, কানায় কানায় পরিপুর্ণ করে দিয়েছে। মাঝে মাঝে নিজে নিজেই বলি, আমার যামিনী আছে তাই আমার চেয়ে সুখি ভবে কে আছে?

যা বলছিলাম, খুকুর কথা। শেষ পর্যন্ত গিন্নী মার কথাই বহাল রইলো। টিকেটের ব্যবস্থা হোল। পূর্ব লন্ডনে্র স্টেপনি গ্রীনে এক বাঙ্গালি পরিবারের সাথে থাকার ব্যবস্থা হয়েছ, ছোট্ট একটা রুম ৮ ফুট বাই ১০ ফুট সাইজ তাতে থাকবে সপ্তাহে পঞ্চাশ পাউন্ডের বিনিময়ে। ছোট ভাইয়ের এক বন্ধু আরিফ খোজ খবর করে ব্যবস্থা করে রেখেছে। আর খাবার ব্যবস্থা এখনো ঠিক হয় নি, ও আসুক, কিছু দিন দেখে গুছিয়ে নিয়ে যা ভাল মনে করে তাই করবে, আপাতত এদের সাথেই খাবে এ জন্য আলাদা পনের পাউন্ড। খুকুর জন্য টি মোবাইলের একটা পে এজ ইউ গো ফোন কিনে রেখেছি, সাথে আর যা যা লাগবে বাড়ি থেকে যাতে বোঝা টেনে আনতে নাহয় তার সবই কিনে গুছিয়ে রেখেছি। যাবার সময় সাথে নিয়ে যাব।

দুপুরের পর স্নো থেমে গেল, মনে একটা জোড় পেলাম। রাত ১০টায় কোচ। হয়তো অতক্ষনে মোটর ওয়েতে যা বরফ জমেছে তা সরে যাবে বা সরিয়ে ফেলবে। মটর ওয়ে কি আর বন্ধ থাকলে চলে?

1 comment:

Thank you very much for your comments.